এই মুহূর্তে জেলা

মাত্র ৫০০ টাকায় থমকে ভারত- ফরাসি মৈত্রী।


সুদীপ দাস , ১৮ সেপ্টেম্বর:- চন্দননগর মানেই ফরাসিদের স্থাপত্য যা আজও ইতিহাসপ্রেমী থেকে সাধারণ মানুষ সবাইকে টানে। গঙ্গার তীরবর্তী স্ট্রান্ড, যার টানে ছুটে আসে হাজার হাজার মানুষ, আর স্ট্র্যান্ডের অপরদিকে ক্লক টাওয়ার, সেটিও একটি দস্ট্রব্য স্থান সকলের জন্য। আজও গুগুলে চন্দননগর স্ট্রান্ড লিখে সার্চ করলে, ৫টির মধ্যে ২ টি ছবি আসবে এই ক্লক টাওয়ারের। কোন নামী কোম্পানির নয়, ফরাসিদের নিজস্ব মেকানিজমে তৈরি ম্যান মেড ঘড়ি বসানো হয়েছিল এই ক্লক টাওয়ারে। এতদিন পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ স্ট্র্যান্ডে বেড়াতে এসে এই ঘড়িটির সময় দেখে কাটাতেন গঙ্গার তীরে। মার্চ মাস থেকে শুরু হয় লকডাউন, বন্ধ হয়ে গেছে ক্লক টাওয়ার এর ঘড়ির কাঁটা।

মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে যিনি এতদিন পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে এসে দম দিয়ে চালিয়ে দিতেন ঘড়ি, যার বদলে মাস গেলে তাকে দেওয়া হতো মাত্র পাঁচশত টাকা, সেটিও সরকারিভাবে নয় এখানে তৈরি হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে, সেই ৫০০ টাকার দৌলতে চলতো এই ঘড়ি, চলতো ঘড়ি মিস্ত্রির সংসার। যদিও আগে অনেকবারই খারাপ হয়েছিল এই ঘড়ি, কিন্তু চন্দননগরের বিখ্যাত সেই ঘড়ি মিস্ত্রির হাতে আবার ঘুরেছে কাঁটা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা এই ঘড়িটির। এই ঘড়িটিকে নিয়েই ছিল তার বেঁচে থাকা, সামান্য ৫০০ টাকা, আর তার এই ঘড়ির প্রতি ভালোবাসার জন্য ঝড়-বৃষ্টি সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে ওই টাওয়ারের উপর উঠে ঘড়িতে প্রতিদিন দম দিয়ে যেতেন তিনি। লকডাউন শুরু হতেই ৫০০ টাকার অনুদান বন্ধ করে দেয় হেরিটেজ কমিশন, কারণ তাদের পক্ষে আর এই টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয় বর্তমান পরিস্থিতিতে।

তাদের পক্ষ থেকে সরকার, কর্পোরেশন, পুলিশ প্রশাসন সকলের কাছেই জানানো হয়েছিল ঘড়িটির মেইনটেনেন্স ও ঘড়িতে দম দেওয়ার জন্য মাসিক ভাতার যাতে বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো রকমেই উচ্চবাচ্য করেনি সরকার থেকে প্রশাসন। উহ্য থেকে গিয়েছে মাসিক ভাতার প্রস্তাব, আর সেই কারণেই বন্ধ হয়ে গেছে ফরাসিদের রেখে যাওয়া ঐতিহাসিক ক্লক টাওয়ার এর ঘড়িটি। ঘড়ি মিস্ত্রির এমনিতেই সাংসারিক অভাব কারণ এখন আর তার কাছে ঘড়ি সারাতে কেউই আসে না, একটা সময় ছিল যখন এই নামকরা ঘড়ি মিস্ত্রি, চন্দননগর-চুঁচুড়ার বুকে প্রচুর প্রাচীন ঘড়ির কাঁটা সচল হয়েছিল তার নিপুণ হাতেই। ঘড়িই এতদিন চালিয়ে এসেছে তার সংসার, সর্বশেষ টিকে ছিল ক্লক টাওয়ারের ঘড়িটি, সেটির প্রতি তার মায়া পড়ে গিয়েছিল তার, এই ৫০০ টাকার বিনিময়ে সন্তান স্নেহেই নিয়মিত ঘড়ির দম দেওয়া ও মেনটেনেন্স করে গিয়েছেন তিনি।

বন্ধ হয়ে গেছে মাসোহারা, বন্ধ হয়েছে ক্লক টাওয়ারের দরজা, থমকে গিয়েছে ঘড়ির কাঁটা। প্রতিদিন এখন স্ট্র্যান্ডে এসে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ, নিরুপায় ভাবে ফিরে যায় সে বাগানের ঘাস কাটতে, মিউজিয়ামে। চন্দননগরবাসীর কাছে এই ঘড়িটি শুধু সময় মাপার যন্ত্র নয়, তাদের কাছে এটি গর্বের প্রতীক। আর সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ক্ষুব্ধ হয়েছে অনেকেই। তাদের দাবি অবিলম্বে আবার সচল করা হোক এই ফরাসি নিদর্শনকে। ঘড়ি মিস্ত্রি হয়ে গিয়েছে মালি, ৫০০ টাকার বিনিময়ে যে ঐতিহ্য এতদিন টিকেছিল তার হাত ধরেই, আজ সেই হাতেই ঘাস কাটার কাটারি। থমকে যাওয়া সময় মেশিনের ভবিষ্যৎ যে কি হবে, তা “সময়ই” বলবে।