এই মুহূর্তে জেলা

বন্ধ ট্রেন , গান নয় , পেটের জ্জ্বালায় অভিমানী কান্না নিয়েই চুঁচুড়ার রাস্তায় দৃষ্টিহীনরা !

সুদীপ দাস , ২১ মে:- অভিজিতের হাতে মাইক্রোফোন, কাঠপোড়া রোদে সুরেলা কন্ঠে তুমি মা আমাকে, পৃথিবীর এই আলো দেখিয়েছিলে! সঙ্গী জনা ছ’য়েক। যার মধ্যে এক বছর ছ’য়ের শিশুকন্যাও রয়েছে। শিশুটি ছাড়া সকলেই জন্মগত দৃষ্টিহীন! যদিও ছোটবেলাতেই দৃষ্টিহীনতার দুঃখ এরা হারিয়েছেন। তবে পরপর দু’বছর ট্রেন বন্ধের দুঃখ এঁদের জীবনে নিয়ে এসেছে সত্যিই অন্ধকার। পেটের টানে এঁরা বাইরে বেড়িয়েছেন ঠিকই, তবে এবারে বাইরে বলতে তাঁদের সরাসরি পথে নামতে হয়েছে। ট্রেন বন্ধের জেরে হকারিও বন্ধ। তাই পান্ডুয়ার সিমলাগর থেকে এঁরা উপস্থিত চুঁচুড়া শহরে। শহরের প্রানকেন্দ্র ঘড়ির মোড়ে জামাকাপড়ের দোকানই বেশী। সরকারি বিধিনিষেধে যা তাতে দুপুর ১২টা থেকে ৩টে অবধি জামাকাপড়ের দোকান খোলা। সেইসময়ে শহরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে একটু গান শুনিয়ে যদি কিছু উপার্জন করা যায় আর কি!

অভিজিতের গলায় কখনো কিশোরের তুমি মা আমাকে, পৃথিবীর এই আলো দেখিয়েছিলে, আবার কখনও এতো কান্না, এতো নয় গান, এ যে আমার নীরব অভিমান! অভিজিতের বাড়ি বিহারে। তাঁর স্ত্রী মন্দিরাও জন্মগত দৃষ্টিহীন। অভিজিতের কথায় বিয়ের পর কন্যা সন্তান হতেই নিজের পরিবারের লোকেরা রক্তচক্ষুর কবলে পরলাম। মেয়েকে মানুষ করতেই বিহার ছেড়ে বাংলায় চলে আসা। সিমলাগড়ে ভাড়া বাড়িতে থেকে লোকাল ট্রেনে হকারি করতাম। কিন্তু পরপর দু’বছর ট্রেন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পরেছি আমরা। গতবছর কোনওমতে চালিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু এবছর আর জমানো পয়সা নেই। তাই বাধ্য হয়েই বৌ-মেয়েকে নিয়ে পথে বেড়িয়েছি। গানটা জানতাম। সেই গান গেয়েই পেটের জ্জ্বালা মেটানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। অভিজিতদের সাথে পথে নেমেছেন সিমলাগড়ের আর এক বাসিন্দা সুনীতা চ্যাটার্জীও।

সুনীতার স্বামী ট্রেনের হকার। গত বছর জমানো পয়সায় কোনমতে চলে গেছে। কিন্তু এবার মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কোনভাবেই তা সম্ভব নয়। তাই ঘরে বসে থাকা দৃষ্টিহীন স্বামীকে একটু সাহায্য করতেই পথে নেমেছেন দৃষ্টিহীন সুনীতা। এভাবে পথে নেমেছেন লজ্জা লাগেনা ? এ প্রশ্ন শুনেই সুনীতা কিছুক্ষনের জন্য মুখ লুকায়! তারপরই বুক উচিয়ে বলে আমি বি.এ পাশ ছাত্রী। চাইলেই টিউশন করতে পারতাম। কিন্তু চোখে না দেখায় সাধারন ঘরের ছেলেমেয়েরা আমার কাছে পড়তে আসবে না। তাই বুক ফাঁটা কষ্ট নিয়েই পথে নেমেছি। আশা করোনা শেষে আবার যদি ট্রেন চলে, তাহলে আর এভাবে পথে নামতে হবে না। জীবনযুদ্ধে দৃষ্টিহীনতাকে হারিয়ে হয়তো দৃষ্টিকেই জয় করে ফেলেছে অভিজিতরা। তাই তো ছোট্ট মেয়ে মৌমিতার দৃষ্টিতে দেখে পথ পারি দেয় ওঁরা। আর কন্ঠে বেজে ওঠে তুমি মা আমাকে, পৃথিবীর এই আলো দেখিয়েছিলে।