এই মুহূর্তে কলকাতা

হিটলার থেকে নেতাজীর কণ্ঠস্বর আজও শোনা যায় নকুবাবুর ঘরে।

কলকাতা, ৩ অক্টোবর:- না থেকেও তিনি আছেন ঘরটায়। তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব অনুভব করা যায় এই ঘরে পা রাখলে। উত্তর কলকাতার খান্না মোড় থেকে শ্যাম মিত্র লেনে ঢুকে পুরনো দিনের বাড়ি। উঁচু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে একটা ঘর। পা ফেলার জায়গা নেই বললেই চলে। একজন মানুষের আজীবনের স্বপ্ন ও সাধনার ভাণ্ডার একইসঙ্গে যেন মুক্ত আর বন্দি হয়ে আছে এই ঘরে। নকুবাবু অর্থাৎ সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘অ্যান্টিক’ সংগ্রহের ঘরের নামটিও যথাযথ, ‘অতীতের আশ্রয়’। নিজের কাছে কেমন ছিল এই ঘরটা? তাঁর কথায়- “আমার পৃথিবী মানে তো ওই একচিলতে ঘর! যেখানে আমার ‘ওরা’ থাকে। ‘ওরা’ বলতে আমার সংগ্রহশালার বন্ধুরা। কত দিনের, কত দূরের- সব ঠিকানা আমার স্মৃতির খাঁচায় লিপিবদ্ধ। হ্যাঁ, ওদের কথা আমায় ভাবতেই হয়! কারণ ওরা আমার কাছে নিছক জড়পদার্থ মাত্র নয়। ভালোবাসা পেলে জড়পদার্থের মধ্যেও প্রাণ প্রতিষ্ঠিত যে হতে পারে, সে প্রমাণ তো আমি পেয়েছি এবং প্রতিদিনই পাই। সকালে যখন আমি তিনতলা থেকে দোতলায় নেমে সংগ্রহশালার ঘরটা খুলি, ঘরে আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরা যেন কেমন নড়েচড়ে ওঠে।

আমি সেটা বুঝতে পারি। ওরা যেন বলতে চায়, এসো, তোমার জন্যই আমরা অপেক্ষা করে আছি। তার পর যখন লন্ঠনগুলো, পুরনো নানান যন্ত্রপাতিগুলো ঝাড়পোঁছ করি, ওরা খুশিতে যেন ঝলমলিয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় এবং বলেও। ওদের শব্দহীন নীরব ভাষা আমি বুঝি। এ যেন এক অব্যক্ত জীবনের জ্বলন্ত অভিঘাত”। আদি যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত রেডিয়োর শরীরের যাবতীয় ভাল্‌ভ রয়েছে ওই ঘর জুড়ে। ১৯২৬ সালের জনস্টন রেডিয়োর সঙ্গী মার্কনি ফোনের লাউডস্পিকার জনৈক কাবাড়িওয়ালার থেকে জলের দরে ১২ টাকায় পেয়েছিলেন নকুবাবু। উনিশ শতকের ডোয়ার্কিনের ছাপ মারা বাদ্যযন্ত্র, পিয়ানো বাজানোর সময়ে বিট ঠিক করার মেট্রোনোমও মজুত। রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে ব্রিটিশ মিলিটারির ‘মেসেজ রিসিভার’ও। সেকেলে ব্রিটিশ গোয়েন্দা-কাহিনির সিনেমায় যেমন দেখা যায়, অপরাধীদের চলাফেরার গোপন ছবি তুলে খুঁটিয়ে দেখার বিলিতি ভিডিয়ো রিল ২২০০ টাকায় চেনা এক জনের থেকে কিনেছিলেন তিনি।

ঘরে রয়েছে ৩০০০ রেকর্ডে দুষ্প্রাপ্য গান ছাড়াও চার্চিল, হিটলার, রুজভেল্ট, সুভাষচন্দ্র থেকে রাইচাঁদ বড়ালের কণ্ঠস্বর। রয়েছে আরও কত কী! সুশীলবাবু বলতেন, ‘‘আমি ওদের দয়া করে তুলে আনিনি। ওরাই আমার ভালোবাসার টানে এসেছে, আমায় ধন্য করেছে।’’ জীবন মানে তো মৃত্যুও বটে! কী হবে এদের, যখন জীবনের অধ্যায় ফুরোবে? উত্তরে বলেছিলেন, “আমি যখন থাকবো না তখন এরা সেখানেই যাবে, যেখানে আমার মতো করে এদের কেউ ভালোবাসবে। এরা ভালোবাসার কাঙাল”। নকুবাবুর সেই ‘ভালোবাসা’ আজ প্রজন্মের হাত ধরেছে। অর্থ-প্রলোভনকে যোজন দূরে সরিয়ে, বাবার আজন্মের ভালোবাসাদের, আগলে রেখেছেন নকুবাবুর জেষ্ঠ্যপুত্র গৌতম চট্টোপাধ্যায়। অতীতের আশ্রয়, রয়েছে আগের মতো করেই পরম যত্নে, ‘ভালো বাসা’-য়- উত্তর কলকাতার গলিপথ ধরে শ্যাম মিত্র লেনের অতীতের আশ্রয়েই। শুধু তাই নয়, গৌতমবাবুর হাত ধরে সেই ‘ভালোবাসা’র পথ বেয়েই সদস্য সংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে বর্তমানে, এই ‘অতীতের আশ্রয়ে’।