হাওড়া, ২৮ সেপ্টেম্বর:- কোথাও পুজোমন্ডপে থিমের ছোঁয়া তো আবার কোথাও পুজোয় সাবেকিয়ানা। কোভিডের বাধা কাটিয়ে জমে উঠেছে হাওড়ার পুজো। হাওড়ার বেলগাছিয়া ছাত্র মিলন সংঘের থিমে এবার পুরীর প্রভু জগন্নাথ ধাম। এই পুজোর প্রধান কর্মকর্তা ভাস্কর ভট্টাচার্য জানান, এবছর তাঁদের পুজোর ২১তম বর্ষ। গত ২০০১ সালে ‘জে’ রোড বেলগাছিয়া ছাত্র মিলন সংঘের এ বছরের নতুন আকর্ষণ পুরীর জগন্নাথ মন্দির। পুরীর জগন্নাথ ধামের অনুকরণে এবছরের পূজা মণ্ডপ দর্শনার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। মণ্ডপের আকর্ষণীয় দিক হল মণ্ডপের নিখুঁত হস্তশিল্প এবং একটি জগন্নাথদেবের মূর্তি ও অরুণ স্তম্ভ। এছাড়াও মন্ডপে সুসজ্জিত থাকবে প্রভু জগন্নাথ দেবের নানা লীলার দৃশ্য। দুর্গাপুজোর মণ্ডপের সামনে থাকছে প্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের একটি বড় বিগ্রহ। এছাড়াও গেটে প্রবেশ করার পরে থাকছে প্রভু জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার একটি সুন্দর বিগ্রহ। এর পাশাপাশি হাওড়ার সালকিয়া বারোয়ারিতলায় “লক্ষ্মীর ভান্ডার” মন্ডপে এসে এবার আপনারও হতে পারে লক্ষ্মীলাভ। দেড়শ বছরের পুজোয় এদের চমক প্রতিদিন ১০ জন করে দর্শনার্থীদের জন্য থাকছে ৫০০ টাকা করে নগদ পুরষ্কার জেতার হাতে গরম সুযোগ। লটারির মাধ্যমেই এই লক্ষ্মীলাভের সুযোগ থাকছে সকল দর্শনার্থীদের জন্য। রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প লক্ষ্মীর ভান্ডারের আদলে মন্ডপ গড়েছেন এরা। সংঘ ভবনের পাশের পুকুরে বাঁশের সেতুর মাঝখানে “লক্ষীর ভান্ডার” এর আদলে তৈরী মন্ডপ বিশেষ নজর কাড়বে। এবার সাঁতরাগাছি কল্পতরু স্পোর্টিং ক্লাবের ভাবনায় “মনের দূর্গা”। ক্লাব সদস্যদের কথায়, বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা মহামারীতে জর্জরিত ছিলাম। বিগত বছরেও আমরা জানতাম না যে আদৌ দূর্গা পুজো হবে কিনা? পুজো করতে পারবো কিনা..? একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে আমরা সবাই চলছিলাম। একটা স্তব্ধতা একটা আবদ্ধতা আমাদের গ্রাস করছিলো।
কিন্তু আমাদের মনে ভরসা ছিল নতুন সূর্য উঠবেই। ধরিত্রী আবার শান্ত হবেই। এবং মুছে দিয়ে সব গ্লানি, শারদ প্রভাতে উঠোনে আলপনা পড়বে। রেডিওতে বাজবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার সুমধুর স্ত্রোত্র। এখনও আমরা আতঙ্কে মধ্যে দিয়ে চলছি। কিন্তু নিশ্চিত হয়েছি যে পুজো হবে। আড়ম্বর কম করে হলেও পুজো হবে। এই আশায় কোমর বেঁধে আমরা আবার সামিল হয়েছি। ৩৯তম বর্ষে প্রাণের চালচিত্র দিয়ে মনের ম করে দেবীকে সযত্নে সাজিয়েছি। মধ্য হাওড়ার রামকৃষ্ণ অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজোর এ বছর ৫১তম বর্ষ। এদের পুজোয় এবারের থিম “কারিগর”। অর্থাৎ শারদ উৎসব সার্বজনীন থেকে যেভাবে আজকে বিশ্বজনীন হয়েছে এর নেপথ্যে যে সমস্ত কারিগরদের ভূমিকা অনস্বীকার্য তাদেরকেই মন্ডপে থিমের মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়েছে। যেমন, দেবীর মূর্তি বানান যে কারিগর, যারা ঠাকুরের সাজ বানান সেই কারিগর, যারা প্যান্ডেল তৈরি করেন সেই কারিগর, যারা আলোক শিল্পী সেই কারিগর, যারা ঠাকুরের সোলার কাজ ডাকের সাজ বানিয়ে থাকেন এমনই নেপথ্যের সব কারিগরদের সম্মান জানাতেই এবারে এদের থিম কারিগর। পুজো কমিটির সম্পাদক সঞ্জয় বসু জানান, মন্ডপে আমরা মোহন বাঁশি রুদ্রপাল, যতীন্দ্রনাথ পাল, কার্তিক পাল, রমেশ পাল সহ বিভিন্ন প্রথিতযশা স্বনামধন্য মৃৎশিল্পীদের ছবিতে প্রদীপের মাধ্যমে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছি আমাদের মন্ডপে। আজকে দুর্গাপূজা ইউনেস্কো থেকে সম্মানিত হয়েছে। সার্বজনীন থেকে এই বিশ্বজনীন দুর্গোৎসবের নেপথ্যের কারিগরদের আমরা সম্মানিত করেছি।
পাশাপাশি, হাওড়া সরস্বতী ক্লাবের এবছর ৭৬তম বর্ষ দুর্গোৎসব। এদের থিম “সময় সময়ে কথা বলে”। পৃথিবীর অন্যতম সম্পদ হলো সময়। গত দু’বছর যেমন মহামারী প্রকোপে আমরা লকডাউন নামক শব্দের সঙ্গে পরিচিত হই এবং স্বাধীন মানুষ হয়েও হঠাৎ আমরা খাঁচার পাখির মতো বন্দী দশা জীবন অনুভব করতে থাকি, তখনই ধীরে ধীরে সেই পাখির বন্দিদশার অবস্থা আমরাও অনুভব করতে থাকি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে খাঁচার সেই পাখিগুলি বিশাল আকাশে যখন মুক্তির ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে, মহামারীর সেই সময় আমরা উদ্বিগ্ন হই জীবন থেকে মুক্ত হয়ে আবার খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। এই বছরের দুর্গাপূজার মন্ডপে আমরা এই অনুভূতিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।সময়ের মূল্য সময় দিতে পারে তাই সময়কে প্রাধান্য দেওয়াটাই আমাদের নৈতিক কর্তব্য। এটাই আমরা পূজামন্ডপে তুলে ধরেছি। সময়ের থেকে বেশি শিক্ষা আমাদের আর কেউ দিতে পারে না। সময় যে সময়ে কথা বলে বা উত্তর দেয় তা আমরা জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুভব করতে পেরেছি। তা নিয়েই এদের থিম ভাবনা। হাওড়ার ঐতিহ্যবাহী ব্যাঁটরা অন্নপূর্ণা বারোয়ারী ও হাওড়া অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতির পুজোর এ বছর ৮৯তম বর্ষ। বরাবরই সাবেকি পুজোয় এরা বিশ্বাসী। এবছর প্রতিমা সাবেকি হলেও মন্ডপে এরা থিমের কারুকার্য করেছেন। ক্লাবের তরফ থেকে জানা গেছে, এবার এদের থিম “শিল্পময়ীর শিল্পকথা”। অর্থাৎ গ্রাম বাংলার শিল্পকে এদের মন্ডপে তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে যেমন থাকছে পটে আঁকা ছবি, পাশাপাশি তালপাতা, প্রদীপ, পুতুল সহ নানাবিধ উপকরণ দিয়ে মন্ডপ সাজানো হয়েছে। দেবীমূর্তির এখানে সনাতন রূপ। বরাবরই এদের মন্ডপ দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে।
এবারও মানুষের যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন পুজো উদ্যোক্তারা। সাঁতরাগাছি স্পোর্টিং ক্লাব (দক্ষিণরোয়তলা দুর্গাপুজা সমিতি) এর এবারের পুজো সাবেকি। ৪৩তম বর্ষের পুজো আজও সাবেকিয়ানাকেই বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই আমাদের এবারের ভাবনা “সাবিকিয়ানা বেচে থাকুক”। পুজো উদ্যোক্তারা জানান, থিম পুজোর ইঁদুর দৌড়ে তারা বিশ্বাস করেন না কারণ মনে হয় মা দুর্গাকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা দিয়ে আরাধনা করাটাই শারদোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। থিম পুজোর জন্যে যে অর্থের প্রযোজন হয় সে অর্থ খরচের সামর্থ্য থাকলেও আমরা সে অর্থ দিয়ে সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করি। আমরা বিগত দশ বছরের বেশি সময় ধরে বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা, বিনা খরচে চিকিৎসা, রক্তদান শিবির, কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র, বুস্টার ডোজ ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও আমরা বিগত কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে বৃক্ষ রোপন এবং শিশু উদ্যান পরিচালনায় নিযুক্ত আছেন ক্লাব সদস্যরা। এবার পুজোয় দুই শতাধিক মানুষের হাতে বস্ত্র তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়াও মহাপঞ্চমীতে পুজোর উদ্বোধন এবং উদ্বোধন করবেন রামরাজতলার শঙ্কর মঠের মহারাজ। এই বছরও কোভিড বিধি মেনেই পুজোর আয়জন করেছি এবং তার জন্য আমরা মণ্ডপের দুই দিক খুলে রেখেছি যাতে মানুষ একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পুজোর আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। বিনামুলে মাস্ক ও স্যানিটাইজার এর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।