কলকাতা , ৫ ফেব্রুয়ারি:- চ্যালেঞ্জের বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্য সরকারের শেষ অন্তর্বর্তী বাজেটে চমকের প্রত্যাশা করেছিল সব মহল।সেই প্রত্যাশা কে ছাপিয়ে গিয়ে তিন মাসের অন্তর্বর্তী বাজেটে একাধিক নতুন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন প্রকল্প ঘোষণার পাশাপাশি বাজেট বক্তৃতার পুরোটা জুরে নির্বাচনী ইশতেহারের ধারে একের পর এক প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে।এমনকি, বাজেট পেশের একেবারে শেষ লগ্নে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে,আপনারা আমায় বিশ্বাস দিন, আমি আপনাদের নিঃশর্ত সেবা দেব। পরোক্ষে যাকে ভোট প্রার্থনা বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অর্থমন্ত্রীর পরিবর্তে খোদ মুখ্যমন্ত্রী বাজেট পেশ করায় এমনিতেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়েছে বিজেপি সহ বিরোধীরা। তার উপরেমাসের অন্তর্বর্তী বাজেটে একের পর এক নতুন নতুন প্রকল্প ঘোষণা করায় নতুন করায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিরোধী শিবিরে। এই সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতিকে তাঁরা প্রহসন আখ্যা দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর অনুপস্থিতিতে শুক্রবার রাজ্য বিধান সভায় আগামী অর্থ বছরের এপ্রিল থেকে জুন তিন মাসের অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, রাজ্য়ের ১ কোটি মানুষকে স্বাস্থ্য় সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। আগামী দিনে এইসব প্রকল্প রাজ্য়বাসীর কাছে একটা নজির হয়ে থাকবে। বছরে দু-বার পাড়ায় পাড়ায় সমাধান ও দুয়ারে সরকার প্রকল্প চলবে। একবার অগস্ট- সেপ্টেম্বর ও আরেকবার ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে হবে এই প্রকল্পের কাজ।
শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, এ বিষয়ে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দও করা হয়েছে। মুখ্য়মন্ত্রীর কথায়, আগামী দিনে রাজ্য়বাসীর কাছে এই প্রকল্পগুলি একটা নজির হয়ে থাকবে। এদিন অন্তর্বর্তী বাজেটে মুখ্যমন্ত্রী আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্যে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার ব্যায় বরাদ্দর প্রস্তাব পেশ করেছেন। জুনের পরেও বিনামূল্য়ে রেশন দেওয়ার কথা ঘোযণা করেন মুখ্য়মন্ত্রী। তিনি বলেন,২০২১ সালের জুন মাসের পরেও বিনামূল্য়ে রেশন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। স্বাস্থ্য়সাথী কার্ডের জন্য় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্রতি তিন বছর পর এই স্বাস্থ্য়সাথী কার্ড রিনিউ হবে। রাজ্য়ে দুয়ারে সরকার প্রকল্পে নতুন করে ৬০ লক্ষ পরিবার নতুন করে স্বাস্থ্য়সাথী কার্ড পেয়েছে বলে দাবি করেছে রাজ্য় সরকার। এই স্বাস্থ্য় প্রকল্পের মাধ্য়মে ৫ লক্ষ টাকা চিকিৎসার খরচ বাবদ পাওয়ার কথা রাজ্য়বাসীর। কিন্তু দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্য়সাথীর কার্ড থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা দিতে মানা করে বেসরকারি হাসপাতাল। সেক্ষেত্র তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্য়বস্থা নেওয়ার আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুখ্য়মন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি ধাপে ধাপে রাজ্যের দেড় লাখ উদ্বাস্তুকে জমির দলিল দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। নেতাজির নামে কলকাতা পুলিশে নেতাজি ব্যাটেলিয়ান তৈরি করা হবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানান। নেতাজি যোজনা কমিশনের জন্যে তিনি পাঁচশো কোটি টাকা বরাদ্দর প্রস্তাব রাখেন। স্বল্প মূল্যে রান্না করা খাবার সাধারনের কাছে পৌঁছে দিতে মা নামে নতুন একটি প্রকল্পের কথা তিনি ঘোষনা করেন। এই জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে একশো কোটি টাকা। বর্তমানে পুলিশ এবং বিভিন্ন বিভাগ মিলিয়ে যে এক লক্ষ ১০ হাজারের বেশি পদ শূন্য রয়েছে আগামী তিন বছরের মধে সেগুলি পূরন করা হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। আগামী দুই বছরের মধ্যে অন্ডাল বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। পার্শ্ব শিক্ষক এবং চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের প্রতি বছর তিন শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা করা ছাড়াও অবসর গ্রহণের সময় তাদের এককালীন তিন লক্ষ টাকা দেওয়া হবে বলেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন। অলচিকি লিপির সম্প্রসারণে আরো পাঁচশো টি নতুন বিদ্যালয় এবং দেড় হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হবে।
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণা খুব একটা মসৃণ হয়নি। এদিন মুখ্য়মন্ত্রী বাজেট পড়তে শুরু করলেই হট্টগোল শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা। বার বার বলেও বসানো যায়নি তাদের। বিরক্ত হয়ে নিজেই বাজেট পড়া শুরু করেও বসে পড়েন মুখ্য়মন্ত্রী। শেষে বিধায়কদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্য়োপাধ্যায়। কিন্তু তাতেও শান্ত করা যায়নি পরিস্থিতি। এক সময় বিজেপি বিধায়কদের এই বিক্ষোভের নিন্দা করেন স্পিকার। বিমানবাবু বলেন, সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলতে উঠলে এই ধরনের হইচইয়ের মুখে পড়তে হয় না তাঁকে। বিধায়কদের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মর্যাদার কথা মনে করান স্পিকার। পরে এ প্রসঙ্গে মুখ্য়মন্ত্রী বলেন, আমি নিজেই ৫টা রেল বাজেট পেশ করেছি। বাজেটের সময়ে কেউ কোনও কথা বলে না। কিন্তু আমি জানি না, বিজেপির এই সদস্যরা কিছু জানেন কি না। প্রোটোকল অনুযায়ী, কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষেত্রে বাজেট পেশ সাধারণত অর্থমন্ত্রীরাই করে থাকেন। যদিও পরিষদীয় মন্ত্রী এই কাজ করতে পারেন। এবার একেবারে নজিরবিহীন ভাবে সেই দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন মুখ্য়মন্ত্রী। বাংলার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র অসুস্থ হওয়ায় এবার বাজেট পেশ করতে পারেন নি। যদিও সাংবাদিক বৈঠকে অনলাইনে উপস্থিত ছিলেন তিনি। এদিকে অন্তর্বর্তী বাজেট নিয়ে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বিরোধীরা। বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীর একের পর এক প্রকল্প ঘোষণাকে ‘প্রহসন’ বলে কটাক্ষ করেন।অধুনা বিজেপি নেতা প্রাক্তন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন বিজেপি শমীক ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, “বর্তমানে অর্থনৈতিক যা পরিস্থিতি তাতে কীভাবে মুখ্যমন্ত্রী এতগুলি প্রকল্প ঘোষণা করলেন, এত কোটি টাকা বরাদ্দ করলেন জানি না। কোথা থেকে এত টাকা আসবে তাও জানিনা। সাধারণ মানুষ প্রকল্পের প্রহসন প্রত্যাখ্যান করবে বলেই আমার বিশ্বাস। এতদিন দুয়ারে সরকারে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে সরকার। বলা হচ্ছে ১০ কোটি মানুষ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত পরিষেবা পাবে, অথচ বরাদ্দ সামান্য কিছু টাকা।” তাঁর কথায়, অশোকনগরের তেল উত্তোলনে কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে দেউচা-পাচামি সবকিছুই কেন্দ্রের, কিন্তু রাজ্য নিয়োগের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যা ঠিক নয়। এদিন পার্শ্বশিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রসঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রীকে একহাত নেন শমীক। বলেন,“বহুদিন ধরে পার্শ্বশিক্ষকরা আন্দোলন করছেন। প্রায় একবছর ধরে প্রতিদিন বিকাশ ভবনের সামনে দেখছি ওনারা অবস্থান করছেন। আজ এতদিন পর মুখ্যমন্ত্রীর ওদের কথা মনে পড়ল।” বাজেট প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছেন বাম নেতা সুজন চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, “অযথা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন উনি। এটা কোনও বাজেটই নয়। ৫০ কোটি টাকার উপর ঘাটতি। উনি যা বলছেন সবই পরবর্তী ৫ বছরের জন্য। কিন্তু আপনি থাকবেন ২ মাস। আচমকা ভোটের আগে অনেক কিছু মনে পড়ছে। আগে কেন মনে পড়েনি কেন?” প্রশ্ন তুলেছেন সুজন চক্রবর্তী।