সুদীপ দাস , ১৮ জুলাই:- ধনিয়াখালি থানার ভান্ডারহাটি কেশবপুরে কালিবাড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় অ্যাডবেস্টসের চালের একচিলতে ঘর। এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কোনরকমে দিন গুজরাতেন দেবনাথ দম্পতি। গ্রামের অত্যন্ত সাদামাটা পরিবার বলতে যা বোঝায় আর কি। স্বামী প্রদীপ দেবনাথের করা ১০০ দিনের কাজের টাকায় পেট চালানোর পর ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার খরচ জোগার হচ্ছিলো না। তাই সংসারের হাল ধরতে বাড়ি-বাড়ি শাড়ি বিক্রি করা শুরু করেন গীতা দেবনাথ। পেটে সামান্য বিদ্যা থাকায় স্বামীর ১০০ দিনের কাজের সুপারভাইজার হিসাবে নিযুক্তও হয়েছিলেন গীতা দেবনাথ। এরপর ছেলে মেয়ের পড়াশুনার টাকা মোটামুটি জোগার হচ্ছিলো। গ্রামের আর পাঁচটি পরিবারের মত অভাবের তাড়নায় মেয়েকে কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে দিতে চায়নি দেবনাথ দম্পতি। মেয়ে প্রজ্ঞা যখন ভান্ডারহাটি বিএম হাই স্কুলে পড়ে তখনই তাঁর পড়ার আগ্রহ আঁচ করতে পেরেছিলো বাবা-মা। তাই তাঁরাও ভেবেছিলো একদিন এই মেয়েই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবারের অনটন দূর করবে।
কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে ধনিয়াখালি কলেজে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয় প্রজ্ঞা। ১ম ও ২য় বর্ষ ঠিকঠাকই ছিলো। কিন্তু ৩য় বর্ষে স্নাতক স্তরের শেষবেলায় এসে প্রজ্ঞা কেন যে বাড়ি ছেলে চলে গেলো তা গতকাল পর্যন্ত বুঝতেই পারেনি দেবনাথ পরিবার। আজ সকালে দেবনাথ দম্পতি যখন জানতে পারলো তাঁদের একমাত্র মেয়ে প্রজ্ঞা বাংলাদেশের ঢাকায় জঙ্গি কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছে তখন তাঁদের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পরেছিলো। শুক্রবার বিকেলে ঢাকার সদরঘাট থেকে নিউ জেএমবি ( নতুন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ)-র সদস্য হিসাবে আয়েশা জন্নত মোহনা ওরফে প্রজ্ঞাকে গ্রেপ্তার করে সেদেশের সিটিটিসি (কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম)। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই তদন্তকারীরা জানতে পারে প্রজ্ঞা হুগলির ধনিয়াখালির বাসিন্দা। আজ প্রজ্ঞার মা গীতা দেবনাথ চোখ মুছতে মুছতে বলেন ২০১৬ সালে ২৪শে আগষ্ট আমার শাশুড়ি মা মারা গেলেন আর ঠিক একমাস পর ২৪শে সেপ্টেম্বর মেয়ে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলো। বহু খোঁজাখুজি করেও ওর কোন খোঁজ পাইনি।
বহুদিন পর মেয়ে একদিন বাড়িতে ফোন করে জানালো সে বাংলাদেশে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছে। আমি বলেছিলাম এটা হয়না তুই বাড়ি ফিরে আয়। আমরা আবার তোকে ফিরে পেতে চাই। কিন্তু সেই যে লাইন কাটলো আজ অবধি আর মেয়ের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। অভাবের তাড়নায় আমরাও বাংলাদেশ গিয়ে খোঁজ নিতে পারিনি। মেয়ে চলে যাওয়ার পর ছেলের পড়াশুনাও বন্ধ হয়ে যায়। একটি এজেন্সির হয়ে সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে ছেলে কাজে ঢোকে। কিন্তু লকডাউনের পর থেকে সেই কাজও নেই। গীতা দেবীর কাপড়ের কারবারও লাটে উঠেছে। বর্তমানে আর্থিক দিক থেকে করুন দশা দেবনাথ পরিবারের। অশ্রু সজল চোখে গীতাদেবীর আর্তনাদ এত কষ্ট করে মেয়েটাকে মানুষ করলাম তার মূল্য দিলো না ও। বুকে পাথর চাপা কষ্ট থাকলেও আমাদের সামনে স্বাভাবিক হওয়ার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন প্রজ্ঞার বাবা প্রদীপ দেবনাথ। অভিমানী সুরে প্রদীপবাবু বলেন “যেমন কর্ম, তেমন ফল”। ও যদি জঙ্গি হয় তাহলে তার সাজা ও পাবেই!!