হুগলি , ১৪ জুলাই:- গঙ্গার পশ্চিম তীর ঘেঁসে ওঠা শ্রীরামপুর শহরের একাধিক স্থাপত্য ও নিদর্শন কে হেরিটেজের তকমায় ভূষিত করেছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। এবারে হেরিটেজের তালিকায় নতুন সংযোজন হল শ্রীরামপুর চাতরার কাশীশ্বর পীঠ। যাকে স্থানীয়রা দোলতলার দোলমন্দির হিসেবে চেনে। দ্বিতীয়টি হল শ্রীরামপুর আদালতের উল্টোদিকে অবস্থিত ডেনিস ট্যার্ভান। ভুতুরে বাড়ি আখ্যা পাওয়া দীর্ঘদিন ভগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকা ডেনিস ট্যার্ভান জীর্নতা ঝেড়ে নতুন ভাবে সেজে উঠেছে ন্যাশানাল মিউজিয়াম অব ডেনমার্ক ও রাজ্য সরকারের অর্থানুকূল্যে। পুরনো আদল বজায় রেখেই কলকাতার একটি নামী রেস্তরা ট্যাভানের দায়িত্ব নিয়েছে। সেন্ট ওলাভ গীর্জা থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে অবস্থিত ডেনিস ট্যার্ভানের মুকুটে হেরিটেজের তকমা জুটতেই উচ্ছসিত শহরবাসী। চাতরা কাশীশ্বর পীঠ তথা দোলতলার দোল মন্দির কমিটি জানিয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে চাতরা দোলতলায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন কাশীশ্বর পন্ডিত। তিনি শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ ছিলেন।এই মন্দির ও ঐতিহ্য কে রক্ষা করার জন্য মন্দির কমিটি ২০১৯ সালে রাজ্য হেরিতেজ কমিশনের কাছে দোলমন্দির কে হেরিটেজ করার আবেদন করে।
মন্দির কমিটের আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০২০ সালের গোড়ায় রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের একটি দল মন্দির পরিদর্শন করেন।মন্দির কমিটির সুপারিশ মেনে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন দোলমন্দির কে হেরেটেজের স্বীকৃতি দিতেই রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ও মুখ্যমন্ত্রী কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তারা।এক কাঠার কম জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা মন্দিরের গঠন শৈলীর সঙ্গে উড়িষ্যার মন্দিরের বেশ কিছুটা মিল লক্ষ্য করা যায়। তিনটি চূড়া নিয়ে গড়ে ওঠা মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্য মহাপ্রভু ও বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তি রয়েছে। তবে কৃষের আদলে চৈতন্যর মূর্তি মন্দিরের অন্যতম বৈশিষ্ট। দোল, রাস পূর্ণিমা, জন্মাষ্ঠমী নানা সময়ে মন্দিরে পুজা পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ কাশীশ্বর পন্ডিত গঙ্গা তীরে মন্দির গড়ে চৈতন্যের মূর্তি বসিয়ে পুজা করতেন।সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়ার মূর্তিও ছিল।পুরি যাওয়ার পথে চৈতন্য মহাপ্রভু কাশীশ্বর পীঠে আসেন।তিনি মন্দিরে তাঁর মূর্তি দেখে পার্ষদ কাশীশ্বর কে তিনি বলেন, আমার মূর্তির কেন পুজা করছ।তুমি কৃষ্ণের পুজা কর।তিনি জগতের অধীশ্বর। চৈতন্যের কথার উত্তর দিতে গিয়ে শিষ্য কাশীশ্বর বলেন, আমার কাছে আপনিই কৃষ্ণ।আমি আপনাকে কৃষ্ণ ঞ্জানেই সেবা করি।তারপরেই মন্দিরের রাধা কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়। মন্দিরের সহ সম্পাদক পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এটা আমাদের কাছে পরম সৌভাগ্যের।আমাদের আবেদন মেনে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন দোলমন্দির কে হেরিটেজের আওতায় এনেছে।আমরা চাই আমাদের ঐতিহ্য এভাবেই অক্ষত থাকুক।
শ্রীরামপুর শহরে ডেনিস শাসন কালে শহরের ঠিক মাঝখানে আদালত ও সেন্ট ওলাভ গির্জা লাগোয়া রাস্তার উপড়ে ১৮৭২ সালে ১৫ হাজার বর্গফুট জমির উপরে তৈরি হয় ডেনিস ট্যার্ভান বা ডেনিস সরাইখানা।একটা সময়ে কলকাতা ও পাশ্ববর্তী এলাকা থেকে দ্বিতল এই ট্যার্ভানে সময় কাটাতেন সাহেবরা। গঙ্গার তীরে মনোরম পরিবেশের সঙ্গে সাহেবদের পান ভোজনের জমজমাট আড্ডা চলত। ইতিহাস কে স্বাক্ষী রেখে সেই সমস্ত স্থাপত্যর মূল্যায়ন করে সেগুলি কে আগের আদলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ডেনিস ট্যার্ভানের জন্য মোট ৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।ডেনিস ট্যার্ভানের দ্বিতলে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের কফি শপ। গঙ্গা লাগোয়া মনোরম পরিবেশের মধ্যে খুব ভালো মতো সময় কাটানোর একটি সুন্দর স্থান হিসেবে তুলে ধরা এই বিষয়ে ডেনি্স মিউজিয়াম যেমন অর্থ বরাদ্দ করেছে তেমনি রাজ্য সরকারের পর্যটন দপ্তর এগিয়ে এসেছে।সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে ডেনিস ট্যার্ভান আগের অবস্থায় ফিরেছে। ২০১৮ সালে নতুন ভাবে সেজে ওঠা ডেনিস ট্যাভার্নের জমকালো উব্দোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ন্যাশানাল মিউজিয়াম অব ডেনমার্কের কিউরেটার বেন্তে উলফ ডেনমার্ক,নরওয়ে ,ফিনল্যান্ড , আইসল্যান্ড ও সুইডেনের রাষ্ট্রদূতেরা। শ্রীরামপুর পুরসভার পুরপ্রশাসক তথা বিদায়ী পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ডেনিস ট্যার্ভান আমাদের শহরের অন্যতম ল্যান্ড মার্ক।রাজ্য হেরিটেজ কমিশন ডেনিস ট্যার্ভান কে হেরিটেজ ঘোষনা করায় শরবাসীর গর্বের সঙ্গে ঐতিহ্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব বৃদ্ধি পেল বলে মনে করি।