কলকাতা , ৮ ফেব্রুয়ারি:- মহিলা থেকে আদিবাসী, ছাত্র-যুব থেকে তাঁত শিল্পী থেকে পরিযায়ী শ্রমিক সকলের জন্যই কিছু না কিছু উপহার রইল। সোকসভা ভোটের আগে আগাগোড়া চমকে মোড়া বাজেট পেশ করল রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ প্রাপ্য রাজ্যের। তা স্বত্তেও রীতিমত চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাজেটে সাধারণ, গরীব, খেটে খাওয়া মানুষের দিকে তাকিয়ে একাধিক নতুন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার তিনি ২০২৪- ২৫ আর্থিক বছরের জন্য ৭ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটের মোট আয়তন ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে বেশকিছু নতুন প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন। পুরনো বেশকিছু প্রকল্পের বরাদ্দ বৃদ্ধির কথাও জানানো হয়েছে। রাজ্যসরকারী কর্মীদের আরও ৪ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছেরাজ্য বাজেটে। মে মাস থেকে তা কার্যকর করা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর পূর্ব ঘোষণা মতো একশ দিনের কাজ প্রকল্পে ভাতা পাচ্ছেন না এমন শ্রমিকদের বকেয়া ভাতা দিতে বাজেটে ৩হাজার ৭-শো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের একশ দিনের কাজ বা এমজি নারেগার বিকল্প হিসেবে বাজেটে ৫০ দিনের কাজ সুনিশ্চিত করতে নতুন কর্মশ্রী প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আগামী আর্থিক বছরের মে মাস থেকে তা কার্যকর হবে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার তালিকাভুক্তদের কেন্দ্রীয় সরকার আগামী একমাসের মধ্যে প্রাপ্য টাকা না দিলে রাজ্য সরকারই তাদের বাড়ি তৈরির টাকা দেবে বলে বাজেট ভাষণে উল্লেখ করা হয়েছে। সিভিক ভলান্টিয়ার এবং ভিলেজ পুলিশদের মাসিক পারিশ্রমিক ১ হাজার টাকাবাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তাদের অবসরকারী সুবিধাও বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করারকথা বলা হয়েছে। চুক্তি ভিত্তিক রাজ্য সরকারী গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মীদের বেতন যথাক্রমে ৩ হাজার ও সাড়ে তিন হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এরফলে ৫০ হাজার এধরনের কর্মীউপকৃত হবেন। মিড ডে মিলে রাঁধুনি ও সহায়কদের ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছেরাজ্য বাজেটে। তারা থেকে
প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা করেপারিশ্রমিক পাবেন। অর্থমন্ত্রীজানান, রাজ্যের দরিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৪৯ শতাংশ কমেছে।
১ কোটি ২৭লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার ওপরে উঠেছেন। অর্থমন্ত্রীজানান, রাজ্যের রাজস্ব আদায় গত আর্থিক বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কেন্দ্রে রকাছে রাজ্যের বকেয়ার পরিমাণ ১ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে অনুদানের বৃদ্ধির প্রস্তাব রেখেছেন। সাধারণশ্রেণীর মহিলারা ৫-শো টাকার পরিবর্তে ১ হাজার টাকা এবং তপশিলি জাতি ও উপজাতি মহিলারাওই প্রকল্পের আওতায় মাসিক বারশ টাকা করে ভাতা পাবেন। সমুদ্র উপকূলবর্তী পূর্ব মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনার মৎস্যজীবীদের জন্য সমুদ্র সাথীনামে একটি নতুন প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকে। রাজ্যসরকার সমুদ্রসাথী প্রকল্পের অধীনে এই দুই মাসে ৫ হাজার টাকা করে মৎস্যজীবীদেরপ্রদান করবে। এই খাতে ২-শো কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। উপকৃত হবেন প্রায়২ লক্ষ মৎস্যজীবী। হ্যান্ডলুম এবং খাদিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাঁত শিল্পীদের জন্য বাজেটে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই খাতে বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে ৫-শো কোটি টাকা। ৪ লক্ষতাঁত শিল্পী এতে উপকৃত হবেন।
তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পের আওতায় এবার থেকে একাদশ শ্রেণীর পড়ুয়ারাও মোবাইল ও ট্যাব কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা করে পাবেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। নিজেদের কর্মস্থলেই এর সুবিধাপাবেন তারা। এতে ২৮ লক্ষের বেশি পরিযায়ী উপকৃত হবেন বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মুড়িগঙ্গা নদীর ওপর ১২০০ কোটি টাকা ব্যায়ে নতুন সেতু নির্মাণ করা হবে তার নাম হবে গঙ্গাসাগর সেতু। আগামী আর্থিক বছরের বাজেটে এজন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। রাজ্যে চার নতুন অত্যাধুনিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে পথশ্রী-৩ প্রকল্পের আওতায় নতুন রাস্তা নির্মাণ ও ১২ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তার উন্নতি কল্পে ৩৮৬৮ কোটি টকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। বাজেটে কিছু কর ছাড়েরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও ছোট যাত্রীবাহী গাড়ির কর কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকদের বিতর্কিত লাক্সারি ট্যাক্সের পেনাল্টি ও ইন্টারেস্ট সম্পূর্ণ মুকুব করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
দানপত্র দলিলের ক্ষেত্রে স্ট্যামপ ডিউটির হারও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমানো হয়েছে। সম্পত্তির ০.৫ শতাংশের বদলে তা সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এবার থেকে বাংলা শস্যবীমা প্রকল্পের আওতায় আলু চাষিদের প্রিমিয়াম দেওয়ার কথাও বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। বাজেট পেশের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।বাজেটের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজকে যে বাজেট পেশ করা হয়েছে তা চমকে দেওয়ার মতো বাজেট। আগেই বলেছিলাম রাজ্য বাজেটে চমক থাকবে। কর্মসংস্থান থেকে নানা সামাজিক ক্ষেত্রের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষের মাথায় করের বোঝা চাপাইনি। মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় জর্জরিত সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।’বাজেট পেশের সময় রাজ্যের অর্থ দপ্তরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কথা বলতেই তুমুল হট্টগোল শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা।
হইচই এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে অর্থমন্ত্রীকে বাজেট পেশ বন্ধ করে দিয়ে বসে পড়তে হয়। চিৎকার চেঁচামেচি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে কে কী বলছেন তা ভাল করে শোনা যাচ্ছিল না। বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বিরোধী বিধায়কদের সংযত হয়ে বসে পড়তে অনুরোধ করেন। কিন্তু কাজ হয়নি। এরপরেই নিজের আসন ছেড়ে উঠে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বিরোধীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “এটা বিধানসভা। দিল্লির বিজেপি পার্টি অফিস নয়। বাজেট নিয়ে যখন বিতর্ক হবে তখন তাঁরা বলতেই পারেন।” দৃশ্যতই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “লোকসভায় ১৪৭ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমরা সেপথে হাঁটতে চাই না।” বিজেপি সদস্যদের উদ্দেশ্যে মমতা বলে ওঠেন, “আপনারা বাংলা বিরোধী। বাংলার ভাল চায় না বিজেপি।” অধ্যক্ষ বিজেপি বিধায়ক তাপসী মণ্ডলকে সতর্ক করেন।