সুদীপ দাস, ২৭ অক্টোবর:- ২০১৪সাল। মানসিক ভারাক্রান্ত ভাই হঠাৎ করেই একদিন ঘরছাড়া হয়ে যায়। তারপর থেকে বহু খোঁজাখুজি হয়েছে। হয়েছে থানা-পুলিশ। কিন্তু ভাইয়ের কোন খোঁজই মেলেনি। একটা সময় লোকমুখে প্রচার হয়ে যায় ভাই এই পৃথিবীতে আর নেই। কোন দূর্ঘটনার কবলে পরে ইহলোক ছেড়ে পরলোকে চলে গেছে ভাই। প্রথম প্রথম মানতে কষ্ট হলেও পেশায় দিনমজুর দাদা সংসারের চাপে একটা সময়ে সত্যিই ভাইয়ের ফিরে আসার আশার আলো নিভে গিয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ সাত বছর পর এক পুলিশ কর্মীর সৌজন্যে ভাইকে ফিরে পেল দাদা! না কোন উপন্যাস কিংবা রূপোলি পর্দার গল্প নয়, বুধবার এই ঘটনারই স্বাক্ষী থাকল চুঁচুড়াবাসী। পুরুলিয়ার মানবাজার থানার খাটছিরি জাবলা গ্রামের বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর অদৃষ্ট মাহাতোর বাস। অদৃষ্টর এক পুত্র সন্তান আর স্ত্রী রয়েছে। এই পরিবারে আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হল অদৃষ্টের ভাই চিত্তরঞ্জন মাহাতো। চিত্তরঞ্জন মানসিক ভারসাম্যহীন। বহুদিন আগেই বাবা-মা মারা যাওয়ায় চিত্তরঞ্জন দাদার কাছেই মানুষ। সেই চিত্তরঞ্জন হঠাৎ করেই ২০১৪সালের এক দুপুরে পথ ভূলে চুঁচুড়ায় চলে আসে। সেই থেকে চুঁচুড়া হাসপাতাল ও ঘড়ির মোড় সংলগ্ন এলাকাতেই জীবনযাপন শুরু হয় চিত্তরঞ্জনের। হাসপাতালে দু’বেলার খাবার আর রাস্তা-ঘাটে এর-ওর কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে চা-বিস্কুট। এটাই দিনপঞ্জি হয়ে ওঠে তাঁর। হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়েই চুঁচুড়া পুলিশ লাইনের কন্সটেবল সুকুমার উপাধ্যায়ের নজরে আসে চিত্তরঞ্জন।
বাঁকুড়ার গঙ্গাজল থানা এলাকার কাপিষ্টা গ্রামের বাসিন্দা সুকুমারবাবু কর্মসূত্রে বেশকিছুদিন পুরুলিয়ায় ছিলেন। সেই সূত্রে পুরুলিয়াবাসীদের ভাষার টানের সাথে পরিচয় সুকুমারের। একদিন কথার ছলে পথ হারানো চিত্তরঞ্জনের ছবি মোবাইলে তুলে সুকুমারবাবু পাঠিয়ে দেন পুরুলিয়ায় নিজের এক বন্ধু পেশায় মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ জীবন দাসকে। জীবনই সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। সেই ছবি দেখেই হারানো ভাইকে চিনতে পারেন অদৃষ্ট। ছবিতে দেওয়া ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করার পরই সবকিছু জানতে পারেন অদৃষ্টবাবু। বুধবার অদৃষ্ট চুঁচুড়ার ঘড়ির মোড়ে ভাইকে নিতে আসেন। ইতিমধ্যে লম্বা দাঁড়ি, চুলে জট পরা উষ্কখুস্ক চিত্তরঞ্জনকে সেলুনে বসিয়ে একেবারে সভ্য-ভদ্র বানিয়ে ফেলেছেন সুকুমারবাবু। ঘড়ির মোড়ে লঙ্কা দার চায়ের দোকানেই মিল হলো দুই ভাইয়ের। লঙ্কা দাও এদিন বিনা পয়সায় চা খাওয়ালেন দুই ভাইকে। সুকুমারবাবু ও বন্ধু চুঁচুড়া সদর মহকুমা শাসকের দেহরক্ষী সতীনাথ মুখার্জী নিজেদের উদ্যোগে পুলিশের গাড়িতে চাপিয়ে চিত্তরঞ্জনকে ঘরে ফেরাতে রওনা দিতে ব্যাস্ত। ঘড়ির মোড়ে তখন থিকথিকে ভিড়। চা-দোকানি, ফল ব্যাবসায়ীদের চোখ ছলছল, কিন্তু মুখে হাসি। রোজ না দেখার মত মানুষটিকেই আজ বিদায়বেলায় একটু ভালো করে দেখতে গাড়ির জানলায় মুখ রাখতে ব্যাস্ত সকলে। সকলেই তখন হাত নাড়ছেন। লাল রঙের চারচাকা গাড়িটা তখন ঘড়ির মোড়ের বুক চিড়ে এগিয়ে চললো চিত্তরঞ্জনের ঘড়ের দিকে।