হুগলি, ২৬ এপ্রিল:- ১৩৬ বছরের প্রাচীন কোন্নগরের শকুন্ তলা রক্ষাকালী পূজোকে কেন্দ্র করে শুধু কোন্নগর নয় আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের আবেগও জড়িত। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শনিবার অনুষ্ঠিত হয় এই পুজো। দেবী মা খুবই জাগ্ৰত। তার কাছে প্রার্থনা করলে মা ভক্তের মনোবাঞ্ছা অবশ্যই পূরণ করেন। এই রক্ষা কালী পূজাকে কেন্দ্র করে এখানে হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয় পূজোর আগের দিন থেকে অর্থাৎ গতকাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে উপোস করে থেকে রাত ১২ টার পর থেকে গঙ্গাস্নান করে দন্ডিকাটা ও ঠাকুরের বেদিতে জল ঢালা। ২৬ শে এপ্রিল শনিবার বিকেলে সূর্যাস্তের পর ভক্তের কাঁধে চেপে মায়ের মন্দিরে আগমন ঘটে। মায়ের প্রতিমা পাঁচ পুরুষ ধরে তৈরি করে আসছে মৃৎশিল্পী বাদল পালের পরিবার। মাটিতে দুধ ও দেশী মদ মিশিয়ে তৈরি হয় মায়ের মূর্তি। মাকে ১০০ ভোরি সোনার গহনায় সাজিয়ে বাদল পালের গোলা থেকে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। সারারাত ধরে চলে পূজো অর্চনা। দূর দূরান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয় মন্দিরে। এখনো পর্যন্ত এই মন্দিরে চলে পশুবলি। একটা দুটো নয়, হাজার ছাড়িয়ে যায়। সারারাত ঢাক ঢোল পূজোর মন্ত্রপাঠ, যাগযজ্ঞের পাশাপাশি চলে ছাগবলি। শোনা যায় শতবর্ষ আগে ডাকাতরা এখানে নরবলিও দিত।
পরে মোষ বলি এবং এখন ছাগবলি দেওয়া হয়। এরপর ভোর ৫ টার সময় সূর্যদয়ের আগেই মায়ের গা থেকে একে একে খুলে নেওয়া হয় সোনার গহনা এবং ভক্তবৃন্দের চোখের জলে গঙ্গায় নিরঞ্জন করা হয় মায়ের প্রতিমা। শোনা যায় একসময় এই পূজো করত ডাকাতরা। সে সময় কোন্নগর ছিল ঠগী ও ডাকাতদের বাস। ডাকাতরা কৃষ্ণা তৃতীয়া বা তার পরের শনিবার রাতে এই কালী ঠাকুরকে পূজো করে সারা বছরের ডাকাতির প্রস্তুতি নিত। ঐ রাতে ডাকাতরা নরবলি, মহিষবলি অথবা ছাগবলি দিয়ে গায়ে রেড়ির তেল মেখে লাঠি হাতে বেড়িয়ে পড়ত ডাকাতির উদ্দেশ্যে। আধুনিক রূপে এখানে শকুন্ তলা রক্ষাকালী পূজা বারোয়ারীরূপে শুরু হয় আরোও পরে। এই পূজো সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়ে আছে ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ থেকে। শোনা যায় কোন্নগরের ইন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নামে এক পূজারী ব্রাহ্মণ একদিন সন্ধ্যায় যখন পূজো করে বাড়ির পথে ফিরছিলেন, এমন সময় তিনি দেখেন সাদা কাপড় পড়ে, খোলা চুলে এক রমণী মূর্তি, যার গা দিয়ে জ্যোতি নির্গত হচ্ছে। দেখে তিনি মুহূর্তে চমকে ওঠেন। কিন্তু তারপরেই ঘোরের মধ্যে তার পিছু পিছু গিয়ে দেখেন ঐ নারীমূর্তি ভাগাড়ের মধ্যে একটা অশ্বত্থ গাছের নীচে এসে বিলীন হয়ে যায়।
এরপর সে রাতেই ঐ ব্রাহ্মণ পূজারী মায়ের স্বপ্নাদেশ পায় ঐ অশ্বত্থ গাছ যেখানে শকুনের বাসা তার নীচেই মায়ের পূজো শুরু করার জন্য। এরপর ঐ ব্যক্তি স্থানীয়দের ডেকে তার স্বপ্নের কথা বলেন এবং সে বছরই ঐ স্থানে ঘট স্থাপন করে পূজো করা হয়। প্রথম দিকে এই পূজো হতো হোগলা পাতা ও তালপাতা দিয়ে ছাওয়া মন্দিরে। ভাগাড়ের মধ্যে অশ্বত্থ গাছে ছিল শকুনের বাসা। আর তার তলায় পূজো হওয়ার জন্য এই কালী মাকে শকুন্ তলা কালী বলে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের মাহাত্ম ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। এবং হাজার হাজার ভক্ত সমাগম ঘটতে থাকে। পূজো উপলক্ষ্যে নিশ্ছিদ্র পুলিশি নিরাপত্তার মোড়কে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা কোন্নগর। চারিদিকে বসেছে সি সি টিভি ক্যামেরা। ভক্তদের যাতে সারারাত ধরে পূজো দিতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য সবরকম ব্যবস্থা গ্ৰহন করা হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে।