কলকাতা, ১০ ফেব্রুয়ারি:- শুক্রবারের পর শনিবারও ক্যাগ রিপোর্ট নিয়ে শাসক- বিরোধী চাপান উতোরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজ্য বিধানসভার বাজেট অধিবেশন। ক্যাগ রিপোর্ট বিভ্রান্তিকর, একপেশে, পক্ষপাত দুষ্ট বলে আগেই তাকে খারিজ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। এদিন রীতিমত পরিসংখ্যান দিয়ে এর স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সমস্ত প্রকল্পের ব্যবহারিক সংশাপত্র নিয়ম মত দিল্লিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংশাপত্র ঠিকমত দেওয়া হয় বলেই পরের ধাপের বরাদ্দ অর্থ পাওয়া যায়। তবে ঠিকমতো হিসাব দেওয়ার পরেও কেন্দ্র বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে। এটা বেআইনি কাজ। অন্যদিকে বাজেটের পক্ষে তিনি বলেন, কল্যাণকর রাষ্ট্রে যে ভাবে সব শ্রেণীর মানুষের স্বার্থে কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে তারই প্রতিফলন ঘটেছে এই বাজেট। সরকার ধারে চলছে বলে বিরোধী দের অভিযোগ খণ্ডন করে তিনি বলেন ঋণ পরিশোধ করা হয় বলেই ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। রাজ্যেরঋণের বোঝা ৪০ থেকে ৩৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। যেখানে কেন্দ্রের ঋণের পরিমাণ ৫৬ শতাংশ। মন্ত্রী আরও বলেন এ রাজ্যে বিভিন্ন প্রদেশের লোক থাকেন।তাদের বাঙালি বলেই গণ্য করা হয় থাকে।সরকারি কর্মসূচির সব সুবিধাই পেয়ে থাকেন। জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের নিরিখে এই সরকার কাউকে বঞ্চিত করেনা। এর পরই ২০২৪-২৫ সালের বাজেট প্রস্তাব বিরোধী হীন সভায় পাস হয়ে যায়। তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক, একজন আই এস এফ বিধায়ক অংশগ্রহণ করেন।
বিজেপির সদস্যরা সভায় বক্তব্য রাখেন যথাক্রমে – বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা, বঙ্কিম চন্দ্র ঘোষ, দীপক বর্মণ, মনোজ কুমার ওরাঁও, অগ্নিমিত্র পল ও শুভেন্দু অধিকারী। সমস্ত বিধায়ক এই বাজেটের বিরুদ্ধে সরকারি বক্তব্যের তা খন্ডন করেছেন। বঙ্কিম ঘোষ বলেন, দিশাহীন বাজেট। কোনও সারবত্তা নেই। ভোটমুখী ও হাততালির বাজেট। দীপক বর্মন বলেন, নতুন কর্মসংস্থান ও শূন্যপদে নিয়োগের কথা বলা হলেও সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন নি অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। মনোজ কুমার ওরাঁও বলেন, মোদী ফোবিয়া ও শুভেন্দু ফোবিয়াতে ভুগছে রাজ্য সরকার। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ আনা হয়েছে । অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ঐ টাকার হিসেব রাজ্য সরকার দিচ্ছে না কেন্দ্রকে। ২০২৪-২০২৫ আর্থিক বছরের বাজেট নিয়ে দুই ঘন্টা ধরে আলোচনা চলে। তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কেরা বাজেটের সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক মহম্মদ আলি বলেন, এ রাজ্যে চারটি কোম্পানির নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল সাইকেল কারখানা গড়ার জন্য। যাতে রাজ্য সরকারকে ‘সবুজসাথী’ প্রকল্পে ভিন রাজ্য থেকে সাইকেল আমদানি করতে না হয়। আই এস এফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী আজ বিধানসভায় বাজেট পর্বের আলোচনায় বলেন, ভাঙড়ের জন্য শুধুমাত্র নয় একটি মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতাল দরকার। এতে জেলাবাসীও উপকৃত হবেন। তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক অপূর্ব সরকার বলেন, রাজ্য সরকারকে ন্যায্য পাওনা দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকার। বিধায়ক অগ্নিমিত্র পল তিনি তাঁর বাজেট বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, পিপিপি মডেলে নতুন চার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার কথা উল্লেখ করেছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
আদৌ তা কি গড়ে উঠবে ? সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায়। সবিস্তারে কিছু বলা নেই। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আজকের সভায় বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, কাট মোশন – কে সমর্থন করে এই বাজেটের বিরোধিতা করছেন তিনি। শুভেন্দু অধিকারি বক্তব্য রাখছিলেন। আচমকা ছন্দপতন। এনিয়ে দিনভর শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে চাপানউতোর তুঙ্গে। বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। পারস্পরিক ঝামেলার সূত্রপাত আজকের সভায়। ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে তারকেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক রামেন্দু সিংহ রায় টিপ্পনি করেন। শুভেন্দু’র বক্তব্য চলাকালীন অনভিপ্রেত ঐ ঘটনার জন্য উত্তেজনা ছড়ায়। রামেন্দু’ র বক্তব্যের পাল্টা জবাব দেন বিরোধী দলনেতা। এতেই চটে যান রামেন্দু। আসন ছেড়ে আসেন তেড়ে। ওয়েল নেমে এলে তখনকার মতো তাঁকে নিরস্ত্র করতে ছুটে যান অরূপ বিশ্বাস। সামাল দেন পরিস্থিতি। তাঁকে লক্ষ্য করে এই মন্তব্যের অব্যবহিত পরেই সাময়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। বাজেট আলোচনার পরিবেশ খানিক জমে ওঠে। অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায় এর পরিপ্রেক্ষিতে আজকের সভায় বলেন, অসংসদীয় শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এরপর শোরগোল থামে এবং ফের নিজের বক্তব্য বলতে শুরু করেন শুভেন্দু অধিকারী। এরপর তিনি বলেন, দেশের শাসক দল, মোদী সরকার, কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট সমালোচনা করা হয়েছে প্রতি ছত্রে ছত্রে। মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর গলায় এক সুর। বক্তব্য সমান সমান। অথচ, মুখ্যমন্ত্রী সহ সরকার পক্ষ বারবার যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর বিষয়টি তুলে ধরে থাকেন।
এই বাজেটে নির্বাচনী বক্তব্যের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের বাজেটে রাজনৈতিক রঙ চড়েছে। পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কেন্দ্র থেকে প্রাপ্য, রাজ্য সরকারের আয়, মদের বিক্রি বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে গিয়ে মদের দোকানের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে, গোটা রাজ্যের ছবি এখন – “মদময় পশ্চিমবঙ্গ”। বাজার থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ও বাড়ছে। তাঁর বক্তব্য শেষ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপির সদস্যরা সভা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কার্যত ওয়াকআউট। সভা শেষের বক্তা তালিকায় তখন পর্যন্ত নাম রয়েছে অথচ বক্তব্য রাখেননি চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এরপর অধ্যক্ষ জানান, বিভাগীয় মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য আজকের সভায় বিরোধীদের বক্তব্য শোনার পর এর জবাবী ভাষণে তিনি তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যে সভাকে আশ্বস্ত করে জানান, বিরোধীরা বড় অসহিষ্ণু। সরকার পক্ষের বক্তব্য শোনার আগ্রহ নেই। ক্যাগ রিপোর্ট নিয়ে যে বক্তব্য বিরোধীদের তা খন্ডন করেছেন তিনি। এরপর অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায়ের অনুরোধে বিধায়ক বাবুল সুপ্রিয় গান পরিবেশন করেন। হিন্দি গান – “কুছ তো লোগ ক্যাহেঙ্গে, লোগ কা কাম হে ক্যাহনা”। এরপর আজকের মতো অধিবেশনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেন অধ্যক্ষ বিমান বন্দোপাধ্যায়। আগামী ১২ ফ্রেবুয়ারি ফের বিধানসভার অধিবেশন সোমবার বসবে।