সুদীপ দাস, ২৪ নভেম্বর:- আকাশছোঁয়া তেলের দাম, নিজের শখের বাইকে প্রতিদিন পেট্রোল ভরতে খরচ প্রায় ২৫০ টাকা। সঙ্গে তেল পুড়িয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। এই দুই থেকে মুক্তি মিলতে গোড়াই কিনে ফেলেছেন এক যুবক। এখন পরিবেশ বান্ধব সেই ঘোড়ায় চেপেই প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সারছেন তিনি। পাশাপাশি নব প্রজন্মের অনেককেই অশ্বারোহী করে তুলতে সাহায্যও করছেন ওই যুবক। বর্তমানে ঘোড় সওয়ারি হিসাবে পরিচিত ওই যুবকের বাড়ি চুঁচুড়া থানার ব্যান্ডেল বলাগর রোডে। এই এলাকার বাসিন্দা তথা প্রাক্তন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মী দীপক কুমার রায় ও গৃহবধু মিনতি রায়ের পুত্র অলোক কুমার রায়। বছর ঊনত্রিশের দীপক প্রায় বছর আটেক ছিলেন সৌদি আরবে। সেখানে একটি কোম্পানীর হেভি ইকুইপমেন্ট অপারেটর হিসাবে কাজ করতেন। ২০২০-র করোনাকালে সেখানকার পাট চুকিয়ে দেশে ফেরেন অলোক। তবে সেখান থেকে একটি জিনিস তিনি নিয়ে এসেছেন হুগলীতে। তা হলো ঘোড়ার প্রতি ভালোবাসা। বাইক প্রেমী অলোকের একাধিক নামিদামী বাইক রয়েছে।
বাকিগুলো অন্যত্র থাকলেও নিজের বাড়িতে রয়েছে একটি রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট। বাড়িতে আসার পর থেকে এই বুলেট নিয়েই নিত্য প্রয়োজনে কাজকর্ম সারতেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিকালে পেট্রোলের উর্দ্ধমুখী দামের জেরে বাইক প্রেমে ভাটা পরতে শুরু করে অলোকের। একদিকে বেডে চলা তেলের দাম তার উপর গাড়ি চালিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের আগুনে ঘি ছেটানো থেকে মুক্তি মেলার ভাবনা শুরু করেন অলোক। তখনই সৌদিতে ঘোড় সওয়ারীর শিক্ষা পাওয়া পরিবেশ সচেতন অলোকের মাথায় আসে ঘোড়ার কথা। তিনি ভাবতে থাকেন আপাতত বাইক গ্যারেজ বন্দি করে যদি ঘোড়ায় চেপেই প্রয়োজনীয় কাজ সাড়া যায় তাহলে একদিকে যেমন তেলের পয়সা বাঁচবে, তেমনই অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধব ঘোড়ায় চেপে বিশ্ব উষ্ণায়নের দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে। পাশাপাশি ইচ্ছুক ব্যাক্তিদের ঘোড় সওয়ারীর প্রশিক্ষন দিয়ে করোনাকালে নামী কোম্পানীর কাজ হারানো অলোকের উপার্জনও হবে। সেইসমস্ত ভাবনা থেকেই প্রথমে চলতি বছর জন্মাষ্টমীর দিন কোলকাতার হেস্টিংস থেকে ২লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কাটিয়াওয়ারা প্রজাতির একটি ছেলে ঘোড়া কিনে নিয়ে আসেন অলোক। ঘোড়ার নাম দেন রাজু।
নিজের বাইকগুলি গ্যারেজ বন্দি করে পেট্রোলের টাকায় ঘোড়াকে খাওয়ানো শুরু করেন তিনি। প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত অলোকের ঘোড়া পোষ মানাতে বেশীদিন সময় লাগেনি। এরপরই অলোকের কাছে ঘোড় সওয়ারির প্রশিক্ষন নিতে বেশ কিছু নব প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা ভর্তি হন। চাহিদা দেখে চলতি মাসের কালী পুজোর দিন হেস্টিংস থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে আরও একটি ঘোড়া কিনে আনেন অলোক। মারোয়ারি প্রজাতির মেয়ে জাতের এই ঘোড়ার নাম দেন মুসকান। মুসকানের বয়স সাড়ে চার বছর। আপাতত এই ঘোড়ায় চেপেই কাছেপিঠে কাজ সারছেন অলোক। অলোকের ছোটানো ঘোড়া টগবগ শব্দে মাতাচ্ছে ব্যান্ডেল সহ আশপাশ এলাকা। অনেকেই এখন অলোকের কাছে প্রশিক্ষন নিতে আসছেন। অলোকের কাছে প্রশিক্ষনরত নব প্রজন্মের এক তরুনী সঞ্জনা মজুমদার বলেন কোলকাতা ছাড়া হর্স রাইডিং শেখার উপায় নেই। তাই ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না। কিন্তু এলাকায় এধরনের সুযোগ পেয়ে আমার বাবা-ই এখানে ভর্তি করে দিয়েছে। অলোকের বক্তব্য বাইকের পেট্রোল কিনতে প্রতিদিন আমার প্রায় ২৫০ টাকা খরচ হতো। উল্টে তেল পুড়িয়ে পরিবেশ দূষনের ভাগীদার হতাম।
তাই ভাবলাম একটি সুস্থ ঘোড়া পিছু প্রতিদিন ৩০০ টাকা খরচ করলেই যখন যথেষ্ট তখন বাইক রেখে পরিবেশ বান্ধব ঘোড়া চাপাই ভালো। কারন এভাবে চলতে থাকলে মাটির তলার তেলও অদূর ভবিষ্যতে শেষ হয়ে যাবে। তাই তখন আগেকার দিনের মত ঘোড়া-ই আমাদের বিকল্প হয়ে উঠবে। কোলকাতা ছাড়া হর্স রাইডিং প্রশিক্ষন রাজ্যে হয়না বললেই চলে। তাই চাহিদাও বেশ ভালো। ইচ্ছা আছে সকলের সহযোগীতা মিললে আমি ব্যান্ডেলে একটি হর্স রাইডিং ক্লাব খুলবো। অলোকের ভাবনাকে কেউ পাগলামি বলুক আর যাই বলুক না কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট পেট্রোলের দাম বাড়ায় বিরোধী নেতারা যখন একদিনের জন্য সাইকেল কিংবা গরুর গাড়িতে চেপে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তখন তেলের দামের আগুনে পুড়ে শখের বাইক গ্যারেজ বন্দি করে দু’দুটো ঘোড়া-ই যে কেউ কিনে নিয়ে নজির সৃষ্টি করতে পারেন তা কিন্তু অলোকবাবুই দেখালেন! আর যা দেখে হাত মাথায় চক্ষু চড়কগাছ বলাগর রোডের বাসিন্দাদের!