এই মুহূর্তে জেলা

প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন গড়বাড়ির দুর্গাপূজাকে ঘিরে লুকিয়ে আছে নানা অলৌকিক কাহিনী।

মহেশ্বর চক্রবর্তী, ২৯ সেপ্টেম্বর:- হুগলির আরামবাগের গড়বাড়ির রাজবাড়ীর দুর্গাপুজোকে ঘিরে নানা ইতিহাস লুকিয়ে আছে। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা এখনও জনশ্রুতি আছে তার বয়স প্রায় ছয়শো বছর। আঞ্চলিক ইতিহাসের পাতা থেকে সেই ঘটনার কথা জানা যায়। পাশাপাশি গড়বাড়ির রায়েদের এই ঐতিহ্যময় পুজোর কথা রামকৃষ্ণ কথামৃততে উল্লেখ আছে বলে দাবী রাজপরিবারের সদস্যদের। জানা গিয়েছে,একজন রাজপুতনা থেকে সিদ্ধ পুরুষ রনজিৎ সিংহ তৎকালীন আরবানগরীর গড়বাড়ি নামে এক জনপদে আসেন। বর্তমানে এটি আরামবাগ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। তখন চারি দিক ঘন জঙ্গল। বন জঙ্গল পরিস্কার করে জমিদারির পত্তন হলো। কয়েকশো গ্রাম নিয়ে শুরু হলো রাজ্যত্ব।তৎকালীন সময়ে রনজিৎ সিংহকে সবাই নাকি রাজা বলেই জানতো। পরবর্তী ক্ষেত্রে রায় নারায়ন উপাধি পেয়ে তিনি হলেন রনজিৎ রায়।

এই রাজাকে ঘিরে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। আজও বহু প্রবীন মানুষজন রাজা রনজিৎ রায়ের নাম করে শ্রদ্ধা ও প্রনাম জানান।তিনি একাধারে একজন রাজা হলেও সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর কোনও সন্তান ছিলো না বলে সব সময়ই তার মনে দুঃখ ছিলো। রাজার সাধনায় তুষ্ট হয়ে মা দুর্গা স্বয়ং শিশু কন্যা রুপে তার বাড়তি এসেছিলেন। একদিন স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঘন জঙ্গল থেকে শিশু কন্যা রুপী মা দুর্গাকে কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যান রাজা রনজিৎ রায়। দেবী দুর্গা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, যতদিন না তুই নিজে চলে যেতে বলবি ততদিন তোর ঘরে মেয়ে হয়ে থাকবো। চলে যেতে বললে আর কখনও ফিরে আসবো না। মেয়েকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর রাজা রনজিৎ রায়ের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে কাটছিলো।

কিন্তু বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাসে মা দুর্গা ফিরে গেলেন স্বর্গে। জানা গিয়েছে, একদিন রাজা তাঁর রাজকার্য নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। মেয়ে খুব বিরক্ত করছিলো। রাজার মনঃসংযোগ ক্ষুন হচ্ছিলো বলে তিনি নিজেও বিরক্ত হলেন। এই সময় মেয়ে রুপী মা দুর্গা রনজিৎ রায়কে জানান, আমার কথা না শুনলে আমি চলে যাবো। বারং বার মেয়ে রাজাকে এই কথা বলায়, রাজা রনজিৎ রায় কিছু না ভেবেই বলেন, যা তোর যেখানে খুশি।তারপর অনেকক্ষন মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশেষে একজন শাঁখাড়ি এসে রাজাকে বললো, তোমার মেয়ে আমার কাছে শাঁখা পড়েছে, তার দাম দাও। মেয়ে বলেছে কুলুঙ্গিতে পয়সা রাখা আছে। এরপরই রাজা তার ভুল বুঝতে পেরে শাঁখারির কাছে কোথায় মেয়ে আছে তা জানতে চাইলেন।

শাঁখারি তাকে রাজার খনন করা দিঘির পাড়ে নিয়ে গেলো।কিন্তু মেয়েকে দেখতে না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং বুক চাপড়ে মা দুর্গাকে ডাকতে লাগলেন তখন দিঘির মাঝখান থেকে নতুন শাঁখা পড়া দশটি হাত দেখা গেলো।কিছু সময় পরই তা মিলিয়ে গেলো। এই অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো চৈত্র মাসের আম্রবারনীর দিনে। সেই থেকে চৈত্র মাসেও দুর্গা পুজো হয় দিঘির মন্দিরে এবং দানমেলা বসে। পাশাপাশি শরৎকালেও রাজবাড়ীতে ঐতিহ্য মেনে দুর্গা পুজো হয়। বর্তমানে রাজার রাজত্ব না থাকলেও প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে পুজো পাঠ হয়। রাজবাড়ীর বংশধরেরা এই সময় মিলিত ভাবে এই দুর্গাপূজোর আয়োজন করেন। রীতি মেনে নৈবেদ্যতে ১৬-১৮ মন আতপ চাল থাকে। ছাগ বলি থেকে শুরু করে প্রাচীন প্রথা প্রচলিত আছে। সবমিলিয়ে এই আরামবাগের গড়বাড়ির রায় রাজবাড়ী দুর্গাপুজো ঐতিহাসিক আলোয় উদ্ভাসিত।