এই মুহূর্তে জেলা

ভালোবাসার দিনের আগেই বসিরহাটের ইন্দ্রজিতের নতুন জীবন ফিরিয়ে দিলেন ‘পেটালস’ এর সমাজসেবী সদস্যরা।

হাওড়া, ১৪ ফেব্রুয়ারি:- বসিরহাট নিবাসী কাঠের কারিগর ইন্দ্রজিৎ ওরফে অলোক চৌধুরীর জীবনের জীবন গাঁথাতে লেখা হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়। মা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ছোট হাসিখুশি পরিবারে স্বচ্ছলতা না থাকলেও আনন্দের অভাব ছিল না। ২০২০ সালে করোনার সময় ইন্দ্রজিৎবাবু নিজেই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বহু মানুষের, যাঁদের অবস্থা সেই সময় দুরাবস্থায় পরিণত হয়েছিল। কখনও অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া, কখনও ওষুধ, ইন্দ্রজিৎ কখনও খাবার নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন অসহায় মানুষের পাশে। কিন্তু নিয়তিকে তো এড়ানো যায়না। সেই বছরেরই জুন মাসে মারাত্মক এক দুর্ঘটনায় প্রায় ১১ হাজার ভোল্টে ঝলসে যায় ইন্দ্রজিতবাবুর শরীরের একাধিক অঙ্গ। কলকাতার এক হাসপাতালে চলতে থাকে চিকিৎসা। মাত্র তিনদিনেই বাদ দিতে হলো বাম হাত। সকলে ভেবেছিলেন ডান হাত নিয়েই কাজ চালাবেন। কিন্তু অদৃষ্টে অন্য কিছু লেখা ছিল। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে বাদ দিতে হয় ডান হাতটিও।

এ যেন ছিল এক অভিশাপ। দুটো হাতের সঙ্গে কোমরের নিচের অংশও অকেজো হয়ে পড়লো। এবার কি করে চলবে সংসার? পরিবারে বৃদ্ধা মা শুরু করলেন হোটেলে রান্নার কাজ। সামান্য অর্থেই পুরো পরিবারকে তিনি এগিয়ে নিয়ে চললেন নিজের কাঁধে। প্রতি মুহূর্তে নিজের সেই অক্ষমতাকে দেখে জীবনটাকে শেষ করে দেওয়ার কথাই ভেবেছিলেন ইন্দ্রজিৎ। এইভাবেই কেটে গেল আরও একটি বছর। এলো ২০২১ সাল। ইন্দ্রজিতের কথা জানতে পারল এক বেসরকারি সংস্থা ‘পেটালস’। তাঁরা সব ঘটনা জেনে পাশে এসে দাঁড়ালেন। সমস্ত কথা শুনে ইন্দ্রজিতের সন্তানের দায়িত্ব তুলে নিলেন ওই সংস্থারই এক সদস্য। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। ইন্দ্রজিৎবাবুকেও তো বাঁচতে হবে। সেই কারণেই ওই সংস্থার সিনিয়র মেম্বাররা উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। এক সহৃদয় মহিলার মাধ্যমে পরিচয় হয় সেকেন্দ্রাবাদের এক দম্পতির সঙ্গে।

খোঁজ মিললো সেখানকার এক সংস্থার যারা ইন্দ্রজিতের জন্য ‘রোবোটিক হ্যান্ডস’ এর ব্যবস্থা করতে পারলেন। কিন্তু এই কৃত্রিম হাতের মূল্য যে অনেকটাই বেশী। দুটি হাত মিলিয়ে একটা বিশাল অঙ্কের অর্থ। কিন্তু না,’পেটালস’ এর সদস্যরা পিছিয়ে যাননি। কারণ তাঁরা যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন। এরপর এদের সহযোগিতায় চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি এদের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে সেকেন্দ্রাবাদ যাওয়া হলো। সেকেন্দ্রাবাদে এদের পাশে দাঁড়ালেন সেই দম্পতিও। চলল আট দিনের এক অপরিসীম যুদ্ধ। দুটি কৃত্রিম হাত লাগানো হল। দু’বছর বাদে ইন্দ্রজিৎ নিজের হাতে জল খেলেন, খাবার খেলেন। হোটেলে বসে বিরিয়ানিও খেলেন। আনন্দে মেতে উঠলেন তিনি। ততদিনে কোমরের ব্যায়ামে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করেছে কোমরের নিচের অংশও। এ যেন এক অদ্ভুত জীবন ফিরে পাওয়ার গল্প।

আনন্দে চিৎকার করে তিনি যেন বলছেন, আমি এবার বাঁচতে পারব। আমার মা আর হোটেলে কাজ করবে না। আমার মা শুধু রান্না করবে আমার জন্য। আর আমি বাঁঁচব আমার পরিবারের জন্য। চিকিৎসার পর এরা দিনকয়েক আগে ট্রেনে হাওড়া ফিরেছেন। এখন ইন্দ্রজিৎ অনেকটাই সুস্থ। ‘পেটালস’ এর সদস্যরা অঙ্গীকার করেছেন আগামী বেশ কয়েক মাস ইন্দ্রজিতের যাতে ঠিক মতো ফিজিওথেরাপি হয়। আজ নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন ইন্দ্রজিৎ। সাথে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অজস্র মানুষকে যাঁরা আজ ওনার মত একই অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। যাঁরা হয়তো কোনভাবে নিজেকে শেষ করার কথাও ভাবছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে ইন্দ্রজিৎবাবু বলেছিলেন, জীবনে যুদ্ধ আছে। যুদ্ধ তো করতে হবেই। কিন্তু হেরে গেলে চলবে না। আমরা আমাদের কষ্টকে জিতে দেখিয়ে দেব। জীবন মানে এগিয়ে চলা। জীবন মানে নতুন অধ্যায়ে নতুন করে যেন গল্প লেখা।