এই মুহূর্তে জেলা

কোভিড কেড়েছে পড়াশুনা, “স্কুল ত্যাগী”-দের শিক্ষাঙ্গনে ফেরাতে বাড়ি-বাড়ি ঢুঁ শিক্ষকদের!

সুদীপ দাস, ৯ ডিসেম্বর:- দৃশ্য -১ বেড়া দিয়ে ঘেরা টালির চালের ছোট্ট ঘর। ঘরের মধ্যে কাঠের জালে রান্নায় ব্যাস্ত গৃহবধু। খাতায় কলমে গৃহবধুর একমাত্র পুত্র সন্তান যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুল থেকে হঠাৎ করেই জনা কয়েক শিক্ষক হাজির বাড়ির চৌকাঠে। ঘরে রান্নায় ব্যাস্ত গৃহবধুকে ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর ও কাজে গেছে! কি করবে বলুন গতবছর একটানা লকডাউনে ওর বাবা কাজ হারিয়েছে। বাধ্য হয়েই মাধ্যমিকের ছেলেকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।
দৃশ্য -২ একটি ঝিলপারে সামান্য কয়েক ফুট জায়গার উপর কোনক্রমে একটু মাথা গোঁজার জায়গা। সেখানেই বাস পরিবারের জনা পাঁচেক সদস্যের। এখানেও পরিবারের সর্বকনিষ্ঠা তথা ৮ম শ্রেনীর ছাত্রীর দেখা পাওয়া গেলো না। সংসারের হাল ধরতে সেও আজ শিশু শ্রমিক!
দৃশ্য – ৩ সরকারী প্রকল্পের বাড়ি। সামনেই বসে দম্পতি। ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করতে একই উত্তর। কাজে গেছে!

দৃশ্য – ৪ বহু খুঁজে পাওয়া গেলো পাসওয়ান পরিবারের ভাড়া বাড়ি। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এই ভাড়া বাড়িতে থাকেন পাসওয়ান দম্পতি। ছেলে ৭ম শ্রেনীর ছাত্র। স্কুল খোলেনি তাই কোভিড শুরুর পর থেকেই আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। তবে অনলাইন ক্লাস কেন করছে না। দাঁত খিচিয়ে ছাত্রের মায়ের সটান উত্তর সরকারকে বলুন স্মার্ট ফোন কিনে দিতে! হতভম্ব শিক্ষকরা নিজেদের পরিচয় দিতে সম্ভিত ফেরে পাসওয়ান দম্পতির। তখন করুন সুরে ছাত্রের মা স্বামীর দিকে ইশারা করে বলেন সামান্য দিনমজুর। লকডাউনে মাসের পর মাস কাজ হয়নি। মাসে বাড়ি ভাড়া দিয়ে প্রতিদিনের সংসার খরচের পর স্মার্ট ফোন কোথা থেকে কিনে দেবো বলুন তো? ২০২০ সালের ২৩শে মার্চের পর থেকেই বন্ধ স্কুল। সম্প্রতি স্কুল খোলাের পর দেখা যাচ্ছে স্কুলছুট থুঁড়ি এদেরকে স্কুলছুট বলাটা ঠিক হবে না। কারন পেটের টানে যারা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, তাঁদেরকে “ছুট” বললে ব্যাকরনগত ভূল তো হবেই। তাঁদেরকে স্কুলত্যাগী বলা যেতে পারে।

চুঁচুড়ার কাপাসডাঙ্গা সতীন সেন বিদ্যাপীঠ (উঃ মাধ্যমিক)-এ এরপর স্কুলত্যাগী পড়ুয়াদের ঘরে ফেরাতে রিতীমত কালঘাম ছুটছে শিক্ষকদের। যদিও ক্লাস নেওয়ার পর প্রতিদিন পড়ুয়াদের ঘরে ফেরাতে ক্লান্তহীনভাবেই ছাত্র-ছাত্রীদের দোরে-দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শিক্ষকরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তরুন কান্তি কুমার একটি তথ্য দিয়ে বলেন এযাবৎ ৫ম থেকে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত মোট ১৭জন শিশুশ্রমিকের পথ বেছে নিয়েছিলো। বিগত কয়েকদিন ধরে তাঁদের বাবা-মায়েদের বুঝিয়ে আমরা ৬জনের পড়াশুনা পুনরায় শুরু করাতে পেরেছি। বাকিদের জন্য চেষ্টা চলছে। ৯ম ও ১০ম শ্রেনীতেও ৭জন স্কুলত্যাগ করেছে। অবাক লাগে এদের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনজনের বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত হয়ে গেছে। আগামী মঙ্গলবার থেকে স্কুলে টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু তাঁরা স্কুল আসছে না। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেইসমস্ত বাড়িতেও পৌঁছন শিক্ষকরা। পরিবারের জন্য চাল।

পড়ুয়াদের সাজেশন প্রশ্নপত্র, স্কুল ড্রেস, খাতা প্রভৃতিও দেওয়া হয়। আর অভিভাবকদের দিকে করজোরে শিক্ষকদের আবেদন দয়া করে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ করাবেন না। যে কোন মূল্যে ওঁদেরকে পড়ার সুযোগ করে দিন। কোনরকম সমস্যা হলে আমরা দেখবো। ইতিমধ্যে সরকারীভাবে ভর্তির জন্য ২৪০টাকা করে বেশকয়েকজনের ফিজ্ও শিক্ষকরা নিজেদের পকেট থেকে দিয়েছেন। এই বিদ্যালয়ের ভূগোল শিক্ষক অভিজিৎ দত্ত বলেন সংসারের টানে পড়ুয়াদের পড়া বন্ধ! একজন শিক্ষক হিসাবে এটা বড় যন্ত্রনার। তবে তাঁদের মধ্যে থেকে যখন কাউকে আমরা স্কুলে ফিরিয়ে আনতে পারছি, তখনের আনন্দ সেই যন্ত্রনার তুলনায় অনেক বড়। তাই আমরা নিজেদের উদ্যোগেই স্কুলত্যাগী পড়ুয়াদের ফেরাতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাই হোক, এ দৃশ্য কিন্তু শুধু সতীন সেন বিদ্যাপীঠের নয়। ঠিকঠাক খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ দৃশ্য বহু স্কুলেরই। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু যতটা বেদনাদায়ক, অভিশপ্ত করোনার প্রকোপে পরে “শিক্ষা-মৃত্যু”র জ্জ্বালা কিন্তু তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়! বরং ঢের বেশী! কারন শিক্ষাই তো সুষ্ঠ সমাজ গড়ে। আর আজকের পড়ুয়ারাই আগামীদিনে সেই সমাজেরই মেরুদন্ড!